টমেটো চাষ একটি লাভজনক এবং জনপ্রিয় কৃষি পদ্ধতি যা বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে প্রচলিত। এটি সবজি হিসেবে অত্যন্ত পুষ্টিকর এবং বাজারে চাহিদা বেশি থাকে। টমেটো চাষের জন্য সঠিক জমি প্রস্তুতি, মানসম্মত বীজ, উপযুক্ত সার প্রয়োগ, নিয়মিত যত্ন, এবং সঠিক সময়ে ফসল সংগ্রহের প্রয়োজন। এখন, টমেটো চাষের বিস্তারিত পদ্ধতি আলোচনা করা যাক:
১. জমি প্রস্তুতি:
টমেটো চাষের জন্য ভালো ড্রেনেজ ব্যবস্থা থাকা উঁচু এবং দোঁআশ মাটি সবচেয়ে উপযুক্ত। জমি চাষের আগে একবার বা দু’বার গভীরভাবে চাষ করতে হবে যাতে মাটি ঝুরঝুরে হয়। এরপর গোবরের সাথে টিএসপি ও এমওপি সার প্রয়োগ করতে হবে।
২. বীজ বপন:
টমেটোর বীজ বপনের উপযুক্ত সময় হলো অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি। বীজতলায় ৫-৬ ইঞ্চি দূরত্বে সারি করে বীজ বপন করা উচিত। বীজ বপনের পর মাটি দিয়ে হালকা ভাবে ঢেকে দিতে হবে।
৩. চারা তৈরি:
বীজ বপনের ১০-১৫ দিনের মধ্যে চারা গজাতে শুরু করে। চারাগুলি ২৫-৩০ দিনের মধ্যে মাঠে রোপণের জন্য উপযুক্ত হয়। রোপণের আগে জমিতে গোবর, ইউরিয়া, টিএসপি, এবং এমওপি সারের মিশ্রণ ভালোভাবে দিতে হবে।
৪. রোপণ:
চারাগুলি একে অপরের থেকে ২.৫-৩ ফুট দূরত্বে এবং সারি থেকে সারি ৩-৪ ফুট দূরত্বে রোপণ করা উচিত। প্রতি গর্তে ১-২ টি চারা রোপণ করা ভালো।
৫. সেচ ও আগাছা নিয়ন্ত্রণ:
প্রথম সেচ রোপণের পরপরই দিতে হবে। এরপর প্রতি ৭-১০ দিন অন্তর অন্তর সেচ দেওয়া প্রয়োজন। আগাছা নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে, যাতে চারা ভালোভাবে বাড়তে পারে এবং রোগের প্রকোপ কম হয়।
৬. রোগ ও পোকা নিয়ন্ত্রণ:
টমেটোর রোগ-বালাই প্রতিরোধের জন্য বীজ বপনের আগে এবং রোপণের পরে সঠিক সময়ে ছত্রাকনাশক ও কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে। সাধারণত টমেটোর জন্য ডাউনি মিলডিউ, ফিউজেরিয়াম উইল্ট, এবং ব্লাইট রোগ প্রধান।
৭. মাচা তৈরি:
টমেটো গাছের বৃদ্ধির সময় মাচা তৈরি করতে হয়, যা গাছকে সোজা রাখে এবং ফলের ওজন ধরে রাখতে সাহায্য করে। মাচা তৈরি করতে বাঁশের খুঁটি বা রড ব্যবহার করা যেতে পারে।
৮. ফল ধরার সময়:
রোপণের ৬০-৭০ দিনের মধ্যে টমেটো গাছে ফুল আসে এবং ১০-১৫ দিনের মধ্যে ফল উত্তোলন শুরু হয়। ফল ধরার সময় গাছের বাড়তি যত্ন নিতে হবে।
৯. ফসল সংগ্রহ:
ফল লাল হতে শুরু করলে তা সংগ্রহ করা উচিত। ফসল সংগ্রহের জন্য সকাল অথবা বিকালের সময় সবচেয়ে উপযুক্ত। প্রথমবারের পর প্রতি ৭-১০ দিন অন্তর অন্তর ফল সংগ্রহ করা যেতে পারে।
১০. সংরক্ষণ ও বিপণন:
সংগ্রহ করা টমেটো শীতল ও শুকনো স্থানে সংরক্ষণ করতে হবে। টমেটোর চাহিদা সারাবছর থাকায় এটি সহজেই বাজারজাত করা যায়।
টমেটো চাষের মাধ্যমে কৃষকরা স্বল্প সময়ে ভালো লাভ করতে পারেন। সঠিক পদ্ধতিতে চাষ করলে প্রতি হেক্টরে ২০-৩০ টন পর্যন্ত ফলন হতে পারে, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
১১. আবহাওয়া এবং জলবায়ু:
টমেটো গাছের জন্য সুষম জলবায়ু এবং পর্যাপ্ত সূর্যের আলো প্রয়োজন। সাধারণত ২১-২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা টমেটো চাষের জন্য আদর্শ। অতিরিক্ত গরম বা শীতল আবহাওয়া টমেটো গাছের বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলতে পারে। বৃষ্টির পানি জমলে তা দ্রুত নিষ্কাশন করতে হবে, নতুবা গাছের শিকড় পচে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
১২. সার প্রয়োগ:
প্রথমে জমি প্রস্তুতির সময় গোবর সার এবং টিএসপি প্রয়োগ করতে হবে। রোপণের ১৫ দিন পর ইউরিয়া, টিএসপি, এবং এমওপি সার গাছে দিতে হবে। এভাবে ২০-২৫ দিন অন্তর অন্তর প্রয়োজনমতো সার প্রয়োগ করতে হবে। সার প্রয়োগের সময় গাছের গোড়া থেকে একটু দূরে প্রয়োগ করা ভালো, তবে সারের পরিমাণ ও সময় ঠিক রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
১৩. প্রুনিং (Pruning):
টমেটো গাছের ভালো ফলন পেতে প্রুনিং বা ছাঁটাই করা প্রয়োজন। প্রুনিং করতে গাছের নিচের পাতাগুলি এবং পার্শ্বিক শাখা ছেঁটে ফেলতে হবে। এতে গাছের প্রধান শাখায় ফলের সংখ্যা বাড়ে এবং ফল গুলির আকারও বড় হয়।
১৪. টমেটোর বিভিন্ন জাত:
বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের টমেটো চাষ করা হয়, যেমন বারি টমেটো-৪ বারি টমেটো-৮, বারি টমেটো-১১, হাইব্রিড টমেটো , ইত্যাদি। প্রতিটি জাতের টমেটোর নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য এবং ফলনের সময়কাল থাকে। নির্দিষ্ট জলবায়ু এবং মাটির ধরন অনুযায়ী টমেটোর জাত নির্বাচন করা উচিত।
১৫. মালচিং (Mulching):
মালচিং একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি যা গাছের চারপাশের মাটিকে আর্দ্র রাখে এবং আগাছার বৃদ্ধি রোধ করে। এটি গাছের জন্য প্রাকৃতিক সুরক্ষা প্রদান করে এবং ফলন বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। মালচিং করতে সাধারণত পলিথিন শীট, খড়, অথবা পাতা ব্যবহার করা হয়।
0 Comments