হাইব্রিড টমেটো হলো দুই বা ততোধিক টমেটো প্রজাতির গুণাবলীকে একত্রিত করে সৃষ্ট একটি প্রজাতি। হাইব্রিড টমেটোর বিশেষত্ব হলো এটি সাধারণ টমেটোর চেয়ে বেশি ফলনশীল, রোগ প্রতিরোধী, এবং পরিবেশগত চাপ সহ্য করতে সক্ষম।
টমেটো চাষ কিভাবে করে?
হাইব্রিড টমেটো চাষের জন্য জমি প্রস্তুতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জমির মাটি হতে হবে দোআঁশ বা বেলে-দোআঁশ। প্রথমে জমি ভালোভাবে চাষ দিতে হবে এবং এরপর জমিতে জৈব সার যেমন গোবর বা কম্পোস্ট মেশানো উচিত। মাটি ভালভাবে চাষ দেওয়ার পরে, জমিকে সূর্যের আলো পেতে দিন, যাতে মাটির ক্ষতিকারক পোকামাকড় ও রোগজীবাণু ধ্বংস হয়।
হাইব্রিড টমেটো বীজ
হাইব্রিড টমেটোর বীজ সরাসরি জমিতে বপন না করে, বীজতলায় চারা তৈরি করতে হয়। সাধারণত বীজতলায় ১০-১২ সেমি দূরত্বে সারি করে বীজ বপন করতে হয়। বীজ বপনের আগে ৮-১২ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখলে বীজের অঙ্কুরোদগমের হার বৃদ্ধি পায়। ৭-১০ দিনের মধ্যে বীজ থেকে চারা গজাবে। চারা ২০-২৫ দিনের মধ্যে মূল জমিতে রোপণের উপযোগী হয়।
চারা রোপণ
চারাগুলো যখন ২০-২৫ সেমি উচ্চতায় পৌঁছায়, তখন তা মূল জমিতে রোপণ করা হয়। প্রতি চারা থেকে চারা ৬০-৭০ সেমি এবং সারি থেকে সারি ৭০-৮০ সেমি দূরত্বে রোপণ করতে হবে। চারা রোপণের পর, চারার গোড়ায় মাটি ভালভাবে চাপ দিতে হবে এবং পরিমিত পরিমাণে পানি দিতে হবে।
সার প্রয়োগ
হাইব্রিড টমেটোর ভালো ফলনের জন্য সুষম সারের প্রয়োগ জরুরি। মাটিতে জৈব সার প্রয়োগের পাশাপাশি রাসায়নিক সার যেমন ইউরিয়া, টিএসপি এবং এমওপি সঠিক অনুপাতে প্রয়োগ করতে হবে। মূল জমিতে রোপণের ১৫-২০ দিন পর প্রথম সার প্রয়োগ করতে হয় এবং এরপর প্রতি ১৫-২০ দিন পর পর আরও দুইবার সার প্রয়োগ করতে হবে।
সেচ ব্যবস্থা
টমেটো গাছে নিয়মিত সেচ প্রদান করতে হবে। তবে অতিরিক্ত পানি জমে থাকা যাবে না। বৃষ্টি হলে জমি থেকে অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
রোগবালাই ও পোকামাকড় দমন
হাইব্রিড টমেটো সাধারণত রোগ প্রতিরোধী হলেও কিছু কিছু রোগ যেমন পাতা পোড়া রোগ, ধসা রোগ, এবং বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড়ের আক্রমণ হতে পারে। এসব রোগ ও পোকামাকড়ের হাত থেকে গাছকে রক্ষা করার জন্য নিয়মিত নজরদারি ও সঠিক কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
ফল সংগ্রহ
টমেটো চারা রোপণের ৬০-৭০ দিন পর ফল সংগ্রহ করা যায়। ফলগুলো যখন সম্পূর্ণ পাকতে শুরু করবে তখন তা সংগ্রহ করতে হবে। হাইব্রিড টমেটোর ফল সাধারণত আকারে বড়, স্বাদে মিষ্টি এবং রঙে উজ্জ্বল হয়।
হাইব্রিড টমেটোর বিভিন্ন জাত আধুনিক কৃষিতে বিপ্লব ঘটিয়েছে। বিভিন্ন প্রজাতির হাইব্রিড টমেটো উদ্ভাবনের ফলে কৃষকদের জন্য উন্নতমানের ফসল উৎপাদন সহজ হয়েছে। নিচে হাইব্রিড টমেটোর বিভিন্ন জাত সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
হাইব্রিড টমেটো জাত
হাইব্রিড টমেটোর বিভিন্ন জাত উদ্ভাবনের মূল লক্ষ্য হলো উচ্চ ফলন, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, এবং জলবায়ু সহনশীলতা বৃদ্ধি করা। বিভিন্ন জাতের হাইব্রিড টমেটো বিভিন্ন প্রজাতির টমেটোর গুণাবলী সংমিশ্রণ করে তৈরি করা হয়, যা কৃষকদের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য প্রদান করে।
হাইব্রিড টমেটো জাত সমূহ
হাইব্রিড-১:
বৈশিষ্ট্য: এই জাতের টমেটো সাধারণত গোলাকৃতি এবং আকারে বড় হয়। ফলের রঙ উজ্জ্বল লাল এবং স্বাদে মিষ্টি। এটি রোগ প্রতিরোধী এবং উচ্চ ফলনশীল। চারা রোপণের ৭০-৭৫ দিনের মধ্যে ফলন দেওয়া শুরু করে।
উপযোগী স্থান: উষ্ণ ও মাঝারি ঠান্ডা আবহাওয়ার জন্য উপযুক্ত।
রূপালী-১:
বৈশিষ্ট্য: রূপালী-১ জাতের টমেটো আকারে মাঝারি এবং উজ্জ্বল লাল। এটি লেট ব্লাইট ও ভাইরাসজনিত রোগ প্রতিরোধী। চারা রোপণের ৬৫-৭০ দিনের মধ্যে ফলন হয়।
উপযোগী স্থান: গ্রীষ্ম ও শীতকালীন চাষাবাদের জন্য আদর্শ।
সিমলা-৪০:
বৈশিষ্ট্য: সিমলা-৪০ জাতের টমেটো আকারে ছোট কিন্তু ফলের সংখ্যা বেশি হয়। এটি চামড়া মোটা ও ত্বক মসৃণ। টমেটোটি টাটকা খাওয়া ও প্রক্রিয়াজাত করার জন্য উপযুক্ত।
উপযোগী স্থান: সমতল অঞ্চলে চাষের জন্য উপযোগী।
নোভা-৬০:
বৈশিষ্ট্য: এই জাতের টমেটো আকারে বড় এবং রঙ উজ্জ্বল লাল। এটি তাপ সহনশীল এবং রোগ প্রতিরোধী। চারা রোপণের ৭৫-৮০ দিনের মধ্যে ফলন দেয়।
উপযোগী স্থান: উষ্ণ ও শুষ্ক এলাকায় চাষের জন্য আদর্শ।
টিএ-৫০০:
বৈশিষ্ট্য: টিএ-৫০০ জাতের টমেটো গোলাকৃতির এবং মাঝারি আকারের। এর রঙ লাল এবং এটি মিষ্টি স্বাদের। এই জাতটি বিশেষভাবে প্রতিকূল আবহাওয়া সহ্য করতে সক্ষম এবং রোগ প্রতিরোধী।
উপযোগী স্থান: উষ্ণ ও শীতল উভয় ধরনের জলবায়ুতে চাষের জন্য উপযোগী।
পুসা রুবি:
বৈশিষ্ট্য: পুসা রুবি একটি উচ্চ ফলনশীল জাত, যার ফলন উজ্জ্বল লাল এবং স্বাদে মিষ্টি। এটি টমেটো মজল্ড ভাইরাস এবং অন্যান্য সাধারণ রোগ প্রতিরোধী।
উপযোগী স্থান: এটি শীতকালীন চাষের জন্য বিশেষভাবে উপযুক্ত।
স্বর্ণাভা:
বৈশিষ্ট্য: স্বর্ণাভা জাতের টমেটো আকারে মাঝারি, রঙ হলদে লাল। এটি তাপমাত্রা সহনশীল এবং পাতা পোড়া রোগের প্রতিরোধী।
উপযোগী স্থান: এই জাতটি সাধারণত গ্রীষ্মকালে চাষ করা হয়।
বারি হাইব্রিড টমেটো ৪
বৈশিষ্ট্য: বারি টমেটো ৪ জাতটি বাংলাদেশের স্থানীয়ভাবে উদ্ভাবিত একটি জাত। এই জাতের টমেটো আকারে মাঝারি এবং ফলের রঙ উজ্জ্বল লাল। এর পুষ্টিগুণ বেশ উচ্চ এবং এটি ভালো স্বাদের জন্য পরিচিত।
ফলন: সাধারণত এই জাতের টমেটো ৬০-৭০ দিনের মধ্যে ফলন দিতে শুরু করে। এটি উচ্চ ফলনশীল এবং রোগ প্রতিরোধী।
চাষাবাদ: উষ্ণ ও শীতকালীন দুই ধরনের জলবায়ুতেই চাষ করা যায়। এটি সমতল জমিতে চাষের জন্য উপযোগী।
বারি হাইব্রিড টমেটো ৮
বৈশিষ্ট্য: বারি টমেটো ৮ একটি উন্নত জাতের টমেটো, যা উচ্চ ফলন এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন। এর ফল গোলাকৃতি, আকারে বড়, এবং রঙ উজ্জ্বল লাল।
ফলন: চারা রোপণের ৭০-৭৫ দিনের মধ্যে ফলন দেয়। এর ফলন অন্য জাতগুলোর তুলনায় বেশি এবং এটি দীর্ঘ সময় ধরে ফল ধরে রাখতে সক্ষম।
চাষাবাদ: শীতকালে এই জাতটি ভাল ফলন দেয়। তবে উষ্ণ জলবায়ুতেও এটি সফলভাবে চাষ করা যায়।
বাহুবালি টমেটো
বৈশিষ্ট্য: বাহুবালি টমেটো একটি উন্নতমানের হাইব্রিড জাত, যা আকারে বড় এবং ফলের রঙ উজ্জ্বল লাল। এর টমেটো আকারে বড় হওয়ার কারণে বাজারে এর চাহিদা বেশি।
ফলন: বাহুবালি টমেটো চারা রোপণের ৭৫-৮০ দিনের মধ্যে ফলন দিতে শুরু করে। এটি রোগ প্রতিরোধী এবং দীর্ঘ সময় ধরে ফসল ধরে রাখার ক্ষমতা রাখে।
চাষাবাদ: গ্রীষ্ম ও শীত উভয় ঋতুতেই চাষযোগ্য। তবে উষ্ণ ও শুষ্ক এলাকায় এটি সর্বোত্তম ফলন দেয়।
বিপুল প্লাস টমেটো
বৈশিষ্ট্য: বিপুল প্লাস টমেটো একটি উচ্চ ফলনশীল হাইব্রিড জাত, যা রোগ প্রতিরোধী এবং তাপ সহনশীল। এর ফল আকারে মাঝারি, গোলাকৃতি এবং রঙ উজ্জ্বল লাল।
ফলন: সাধারণত এই জাতের টমেটো ৬৫-৭০ দিনের মধ্যে ফলন দেয় এবং ফলন ধরে রাখার ক্ষমতা অনেক বেশি। এটি বাণিজ্যিক চাষের জন্য খুবই উপযুক্ত।
চাষাবাদ: শীত ও উষ্ণ জলবায়ুতে চাষ করা যায়, তবে উষ্ণ এলাকায় এর ফলন বেশি হয়।
গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষের সময়
চারা তৈরির সময়
গ্রীষ্মকালীন টমেটোর চারা তৈরির জন্য মার্চ থেকে এপ্রিল মাস সেরা সময়। এই সময়ে বীজতলায় বীজ বপন করতে হয়। চারা তৈরির সময় বীজতলায় ছায়া দিতে হবে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী পানি দিতে হবে, যাতে চারাগুলো সুস্থভাবে বৃদ্ধি পায়।
চারা রোপণের সময়
গ্রীষ্মকালীন টমেটোর চারা মূল জমিতে রোপণের সেরা সময় হলো এপ্রিল থেকে মে মাস। এই সময়ে তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং চারা রোপণের পর গাছগুলো গরমের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে।
ফলন সময়
গ্রীষ্মকালীন টমেটোর ফলন সাধারণত ৬০-৭০ দিনের মধ্যে শুরু হয়। অর্থাৎ মে থেকে জুন বা জুন থেকে জুলাই মাসে টমেটো সংগ্রহ করা যায়।
সেচ ও পরিচর্যা
গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা বেশি হওয়ার কারণে জমিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে সেচ দিতে হবে। গাছের গোড়ার মাটি যেন সব সময় আর্দ্র থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এছাড়া মালচিং পদ্ধতি ব্যবহার করলে মাটির আর্দ্রতা ধরে রাখা সহজ হবে।
রোগবালাই দমন
গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা বেশি থাকায় কিছু রোগবালাই যেমন বেলে ছত্রাক, ভাইরাস এবং বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড়ের আক্রমণ হতে পারে। সঠিক সময়ে কীটনাশক ব্যবহার এবং নিয়মিত গাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে রোগবালাই প্রতিরোধ করতে হবে।
উপসংহার
হাইব্রিড টমেটোর বিভিন্ন জাত কৃষকদের চাহিদা অনুযায়ী বেছে নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। বিভিন্ন আবহাওয়া, মাটির ধরন, এবং অন্যান্য কৃষি শর্তের ভিত্তিতে সঠিক জাত নির্বাচন করলে উচ্চ ফলন এবং রোগ প্রতিরোধ নিশ্চিত করা যায়। এর ফলে কৃষকরা সারা বছরজুড়ে ভালো মানের টমেটো উৎপাদন করতে সক্ষম হন, যা তাদের আয় বৃদ্ধি করে এবং বাজারে টমেটোর চাহিদা পূরণে সহায়ক হয়।