করলা চাষ

করলা চাষ করার আগে করলার সম্পর্কে জানুন বিস্তারিত

করলা এক প্রকার সবজি, অনেকে করলাকে করল্লা, উচ্ছা, উচ্ছে বলেও ডাকে, ইংরেজিতে করলাকে bitter gourd বলা হয়। তেতো স্বাদযুক্ত এই সবজির চাহিদা বাংলাদেশে বেশ ভালো। এর কারণ অবশ্য এর পুষ্টিগুন, প্রতি ১০০ গ্রাম করলায় বিভিন্ন প্রকার পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ যথাক্রমে-

করলার পুষ্টিগুণ

  • ভিটামিন সি: রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।
  • বিটা-ক্যারোটিন: চোখের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
  • পটাশিয়াম: রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
  • আঁশ: হজম শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে।

এছাড়াও অ্যালার্জি প্রতিরোধে এর রস দারুণ উপকারী। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্যও করলা একটি উত্তম সবজি। প্রতিদিন নিয়মিতভাবে করলার রস খেলে রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। বাতের ব্যাথায় নিয়মিত করলা রস খেলে ব্যাথা আরোগ্য হয়। আর্য়ুবেদের মতে করলা কৃমিনাশক, কফনাশক ও পিত্তনাশক।করলার জীবাণু নাশক ক্ষমতাও রয়েছে। ক্ষতস্থানের উপরে পাতার রসের প্রলেপ দিলে এবং করলা গাছ সেদ্ধ করা জলদিয়ে ক্ষত ধুলে কয়েকদিনের মধ্যেই ক্ষত শুকিয়ে যায়। অ্যালার্জি হলে এর রস দু চা চামচ দুবেলা খেলে সেরে যাবে। চর্মরোগেও করলা বেশ উপকারী। এছাড়া জন্ডিস ও লিভারের অসুখে খাবারে অরুচি দেখা দিলে করলা খেলে রুচি আসে।

করলা চাষ করে খুব সহজে লাভবান হওয়া যায়। করলার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশী হওয়ার কারণে এতে পোকামাকড়ের আক্রমণ অন্য ফসলের তুলনায় তুলনামূলক কম হয়। সবজি চাষিদের মধ্যে করলা অন্যতম জনপ্রিয় একটি ফসল , কারন সারাছরই করলার একটা ভালো বাজারদর পাওয়া যায়। সেইসাথে অন্যান্য সবজি ফসলের তুলনায় করলা চাষ অনেক সহজ এবং পরিচর্যাও কম করতে হয়।

করলা সাধারণত তীব্র শীত ছাড়া সারা বছর চাষ করা যায়। আমাদের দেশে বেশ কিছু উচ্চ ফলনশীল হাইব্রিড জাতের করলার জাত রয়েছে এর মাঝে এগ্রো-১ এর লিডার করলা কৃষকদের কাছে বেশ জনপ্রিয় একই সাথে ছক্কা, ছক্কা সুপার, বস করলারও ব্যাপক চাহিদা রয়েছে বাজারে।

করলা চাষ পদ্ধতি

করলা চাষ

মাটি নির্বাচনঃ করলা চাষের ক্ষেত্রে দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটি উপযোগী

সময় নির্বাচনঃ তীব্র শীত ছাড়া বছরের বাকি সময়গুলোতে করলা চাষ করা যায়। করলার বাজারদর সারাবছরই ভালো থাকে তবে অধিক মুনাফা পেতে আগাম চাষ করা যেতে পারে।
আগাম চাষের সময়ঃ জানুয়ারীর শেষ-ফেব্রুয়ারি
সিজনাল সময়ঃ মার্চ-জুলাই

বাংলাদেশে করলা চাষের উপযুক্ত সময়

বাংলাদেশের আবহাওয়া করলা চাষের জন্য খুবই উপযোগী। তবে সবচেয়ে ভাল ফলন পেতে নির্দিষ্ট সময়ে চাষ করা জরুরি।

  • শীতকালীন করলা: নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত শীতকালীন করলা চাষ করা হয়। এই সময়ে জন্মানো করলা সাধারণত মিষ্টি ও সুস্বাদু হয়।
  • গ্রীষ্মকালীন করলা: মার্চ থেকে জুন মাস পর্যন্ত গ্রীষ্মকালীন করলা চাষ করা হয়। এই সময়ে জন্মানো করলা সাধারণত বড় আকারের হয়।

 

হাইব্রিড করলার কিছু জনপ্রিয় জাত

করলা চাষ

  • দিল: উচ্চ ফলনশীল, রোগবালাই প্রতিরোধী।
  • টিয়া: দিবস নিরপেক্ষ জাত, সারা বছর চাষ করা যায়।
  • বীর: উচ্চ ফলনশীল, সুস্বাদু।
  • পায়রা: গজ করলা, ভালো বাজারদর।
  • শুকতারা: উচ্চ ফলনশীল, রোগবালাই প্রতিরোধী।
  • উল্কা মালা: উচ্চ ফলনশীল, সুস্বাদু।

 

বেড তৈরিঃ
বেড পদ্ধতিতে করলা চাষ করলে ফলন ভালো পাওয়া যায় এবং সহজে পরিচর্যা ও হার্ভেস্ট করা যায়। করলা বিভিন্ন মডেলের বেডে চাষ করা যায়। করলার বেড নির্ভর করবে এর মাচার ধরনের উপর। A প্যার্টান ও ইউ আকৃতি দুই ভাবেই করলার মাচা প্রদান করা যায়। A প্যার্টানের মাচাতে ডাবল লাইন বেড এবং ইউ আকৃতির মাচাতে সিংগেল লাইন বেড তৈরি করতে হবে। ডাবল লাইনের জন্য ৩ ফুটের বেড এবং সিংগেল লাইনের জন্য ১.৫-২ ফুটের বেড করতে হয়। উভয় ক্ষেত্রেই ড্রেনের প্রস্থ ১৫.২ ফুট।

মাচা প্রদানঃ
ইউ আকৃতির মাচার জন্য দুই বেডের মাঝখানে ৪.৫ ফুট উচ্চতার খুটিতে ২.৫ ফুট উচ্চতার পার্শ্বখুটিতে মাচা তৈরি করে নিতে হবে। মাচা তৈরি করে মাচার নেট প্রদান করতে হবে। A প্যার্টানের মাচাতে করলা চাষ করতে ৩ ফুট প্রস্থের বেড করতে হবে। সেক্ষেত্রে মাচার উচ্চতা ৭ ফিট করতে হবে।

পরিচর্যাঃ
সময়মতো নিচের ব্রাঞ্চ কেটে দিতে হবে।
কোনো চারার বৃদ্ধি স্বাভাবিক না হলে অথবা রোগাক্রান্ত হলে তা তুলে অন্য চারা রোপন করে দিতে হবে।
ব্রাঞ্চ কাটিং এর সময় চারার গোড়া নাড়ানো যাবে না।
এগ্রো-১ এর স্প্রে শিডিউল অনুসরন করে স্প্রে করলে সহজেই গাছের রোগ এবং পোকার আক্রমন নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব।

করলা চাষে সাধারণ কিছু রোগবালাই এবং তাদের প্রতিকার

করলা চাষ

করলা আমাদের দেশের একটি জনপ্রিয় সবজি। এর সুস্বাদু স্বাদ ও পুষ্টিগুণের জন্য এটি সবার কাছেই প্রিয়। কিন্তু করলা চাষে বিভিন্ন ধরনের রোগবালাই দেখা দিতে পারে যা ফসলের উৎপাদন কমিয়ে দিতে পারে। আসুন জেনে নিই করলার কিছু সাধারণ রোগবালাই এবং তাদের প্রতিকার।

সাধারণ রোগবালাই

  • পাউডারি মিলডিউ: এই রোগে পাতার উপর সাদা পাউডারের মতো আবরণ দেখা দেয়। ধীরে ধীরে পাতা হলুদ হয়ে যায় এবং ঝরে পড়ে।
  • ডাউনি মিলডিউ: এই রোগে পাতার নিচের দিকে বেগুনি রঙের দাগ দেখা দেয়। ধীরে ধীরে পাতা হলুদ হয়ে যায় এবং ঝরে পড়ে।
  • ফল পচা: এই রোগে ফলে নরম দাগ দেখা দেয় এবং ধীরে ধীরে পুরো ফল পচে যায়।
  • মূল পচা: এই রোগে গাছের মূল পচে যায় এবং গাছ মরে যায়।

রোগবালাই প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ

  • সুস্থ চারা রোপণ: সুস্থ ও রোগমুক্ত চারা রোপণ করতে হবে।
  • জৈব সার ব্যবহার: জৈব সার ব্যবহার করে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করা।
  • পর্যাপ্ত জল সরবরাহ: গাছকে পর্যাপ্ত পরিমাণে জল সরবরাহ করতে হবে।
  • ঘন বাগান না করা: গাছের মধ্যে পর্যাপ্ত দূরত্ব রেখে রোপণ করতে হবে।
  • রোগাক্রান্ত গাছ উপড়ে ফেলা: রোগাক্রান্ত গাছ দেখা দিলে তা অবিলম্বে উপড়ে ফেলে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
  • রাসায়নিক দ্বারা নিয়ন্ত্রণ: প্রয়োজনে কৃষি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী নির্দিষ্ট কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে।

জৈব পদ্ধতি

  • ত্রিচোডার্মা ভাইরিডি: এই জৈব কীটনাশক মূল পচা রোগ প্রতিরোধে কার্যকরী।
  • পাঞ্চাগব্য: পাঞ্চাগব্য গাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।

করলা চাষে কীটনাশক

শসা,বরবটি,করলা,তরমুজ, রকমেলন,ধুন্দল, ঝিংগা,চিচিঙ্গা, ঢেঁড়স ইত্যাদি গাছের সিডিউল স্প্রে:
১ম স্প্রে: বীজ থেকে চারার বয়স ৫-৭ দিন (২-৩ পাতা) হলে,
ম্যান্সার(২ গ্রাম)+নাইট্রো (১ মিলি)+ অটোমিডা(১ গ্রাম)
২য় স্প্রে: চারার বয়স ১২-১৪ দিন হলে,
রিডোমিল গোল্ড (২ গ্রাম)+অটোমিডা(১ গ্রাম)+নুট্রাফস এন(২ গ্রাম)
৩য় স্প্রে: চারার বয়স ১৮-২০ দিন হলে,
ম্যানসার(২ গ্রাম)+পেগাসাস(১ মিলি)+নাইট্রো(১ মিলি)
৪র্থ স্প্রে: গাছের বয়স ২৫-২৬ দিন হলে, রিডোমিল গোল্ড (২ গ্রাম)+অটোমিডা(১ গ্রাম)+ড্রিল(১ মিলি)+নুট্রাফস এন(২ গ্রাম)+চিলেটেড জিংক (০.৫ গ্রাম)
৫ম স্প্রে: গাছের বয়স ৩০-৩২ দিন হলে,
টেম্পেস্ট(০.৫ মিলি)+নুট্রাফস ২৪(২ গ্রাম)+সলুবোরন(১ গ্রাম)+ বলবান(১ মিলি)
৬ ষষ্ঠ স্প্রে: গাছের বয়স ৩৭-৩৮ দিন হলে,
ক্যাপরিওটপ(২ গ্রাম)+মোভেন্টো(১ মিলি)+সিয়েনা(১ গ্রাম)
৭ম স্প্রে: গাছের বয়স ৪৩-৪৫ দিন হলে,
ব্যাকটাফ (২ গ্রাম)+পেগাসাস (১ মিলি)+সলুবোরন(২ গ্রাম)+ফ্লোরা(১ মিলি)+নুট্রাফস ২৪(২ গ্রাম)
৮ম স্প্রে: গাছের বয়স ৫০-৫২ দিন হলে,
রিডোমিল গোল্ড(২ গ্রাম)+সিয়েনা(১ গ্রাম)+ড্রিল(১ মিলি)+ মোভেন্টো(১ মিলি)
৯ম স্প্রে: গাছের বয়স ৫৭-৬০ দিন হলে,
ব্লিটক্স(২ গ্রাম)+টেমপেস্ট(০.৫ মিলি)+নাইট্রো(১ মিলি)+নুট্রাফস এন (২ গ্রাম)+চিলেটেড জিংক (০.৫ গ্রাম)
১০ স্প্রে: গাছের বয়স ৬৫-৬৮ দিন হলে,
ক্যাবরিওটপ (২ গ্রাম)+পেগাসাস(১ মিলি)+সিয়েনা(১ গ্রাম)+ফ্লোরা(১ মিলি)+সলুবোরন (২ গ্রাম)
১১ তম স্প্রে: গাছের বয়স ৭৩-৭৫ দিন হলে,
ব্লিটক্স(৩ গ্রাম)+নাইট্রো(১ মিলি)+মোভেন্টো (১ মিলি)+ড্রিল(১ মিলি)
১২ তম স্প্রে: গাছের বয়স ৮০-৮২ দিন হলে,
ক্যাবরিওটপ(২ গ্রাম)+টেমপেস্ট(০.৫ মিলি)+নুট্রাফস ২৪(২ গ্রাম)+বলবান(১ মিলি)+ সলুবোরন (২ গ্রাম)

করলা চাষে সাবধানতা

করলা গাছ পোকামাকড়ের আক্রমণে বেশি ভুগে থাকে। তাই নিয়মিত পোকামাকড়ের উপর নজর রাখতে হবে।করলা গাছে বিভিন্ন ধরনের রোগ দেখা দিতে পারে। তাই রোগ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসা করতে হবে

আরো পড়ুন:-বর্ষাকালে মরিচ চাষ পদ্ধতি 

সোশ্যাল সাইট:-https://www.youtube.com/@AkashKhan-hq8qo

Leave a Comment